চাকুরি নিয়ে সরাসরি নেদারল্যান্ডে আগমন

Photo by Aswathy N on Unsplash

চাকুরি নিয়ে সরাসরি নেদারল্যান্ডে আগমন

নেদারল্যান্ডে চাকুরি খুঁজতে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ

সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কিভাবে নেদারল্যান্ডের মতো একটা দেশে আসলাম, এইখানে জব পাওয়ার পিছনে কি পরিমাণ স্ট্রাগল ছিল, এবং নতুন যারা আসতে চায় তারা কিভাবে শুরু করতে পারে এবং কিছু শিক্ষনীয় বিষয় শেয়ার করব। এই লেখাটি বড় হতে যাচ্ছে তাই সময় নিয়ে পড়ার অনুরোধ রইল।

শুরুটা যেভাবে

বিদেশ নিয়ে ছোটবেলা থেকে আমার অনেক বেশি ফ্যাসিনেশন কাজ করত, বন্ধুদের কাছ থেকে অনেক রূপকথার গল্প শুনতাম। যেখানে সুন্দর গোছানো জীবন যাপন করতে পারব, দূষণ, দূর্নীতি থাকবেনা, ভাবতে হবেনা কোনো নিরাপত্তা নিয়ে। এমন একটা পরিবেশের মধ্যে যেতে চাচ্ছি যেখানে মানুষজন জাজমেন্টাল না, আমার মত হ্যাপি লাইফ লিড করতে পারব। যখন ইউনিভার্সিটি লাইফের শুরু তখন থেকেই আমার এ ইচ্ছেটা আমাকে আরো বেশি জেকে ধরে। ইউটিউবে অনেক ভ্রমণ ভিডিও দেখতাম, এবং ভ্রমণ বিষয়ক ব্লগ পড়তাম, আর আমার অনেক ইচ্ছা করত বিদেশ ঘুরার। আমার পরিবার অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল এবং স্টুডেন্ট হিসেবে আমি খুব বেশি ভালো না হওয়ায় বিদেশ যাত্রার মত বিলাসিতা তখনকার মতো মাটি চাপা দিয়ে দেই।

সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আমার চাকুরী জীবনের বয়স যখন চার বছরের একটু বেশি হয়, তার আগে থেকেই বাংলাদেশ থেকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়াররা ইউরোপ দেশগুলোতে যাওয়ার একটা হিড়িক পড়ে যায়। উনাদেরকে দেখে আমার ইউরোপের মত সুন্দর জায়গায় বসবাস করার বাসনা আবার জাগ্রত হয়। লিংকডইন এ মাঝেমধ্যে বিভিন্ন রিক্রুটাররা নক করত, তখন ভাবলাম যাক একবার চেষ্টা করে দেখি কি হয়।

জব হান্টিং এবং ইন্টারভিউ

২০১৯ এর শেষের দিকে একটা মালেশিয়ান কোম্পানির রিক্রুটার লিংকডইন এ রিচ করে, জব রিকোয়ারমেন্ট আমার স্কিলের সাথে মিলে যাওয়ায় আমি ইন্টারভিউ দিতে আগ্রহী হই। শুরুতে এইচআর/স্ক্রিনিং ইন্টারভিউ হয়, যেখানে আমার ইংলিশের স্পিকিং বেশি ভালো না হওয়াতেও কোন ভাবে পাস করে যাই। তারপর কগনেগেটিভ টেস্ট এবং অনলাইন কিছু এমসিকিউ পরীক্ষা নেওয়া হয়। এগুলো পাস করার পর সফটওয়্যার বানানোর জন্য একটা অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়, যেখানে ওদের কিছু রিকোয়ারমেন্ট থাকে এবং নির্দিষ্ট কিছু টেকনোলজি দিয়ে সার্ভার এপিআই বানাতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই দ্রুত এসাইনমেন্ট সম্পন্ন করে জমা দিয়ে দেই। এসাইনমেন্ট বেশ ভালো হওয়াতে টেকনিক্যাল ইন্টারভিউ এর জন্য ডাক পাই। একজন টিম মেম্বার এবং টিম লিড টেকনিক্যাল ইন্টারভিউ কন্ডাক্ট করে, তারা আমাকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং এর থিউরিটিকাল বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে এবং আমার অ্যাসাইনমেন্ট কিভাবে আরো ভাল করা যায় এই সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করে। আমার ইংলিশ স্পিকিং দুর্বল হওয়ায় ঠিকভাবে সবকিছু বলতে পারছিলাম না, যেটা এক্সপ্রেস করতে চাচ্ছিলাম সেটা ওদেরকে ভালোভাবে বুঝাতে পারতেছিলাম না। টেকনিক্যাল ইন্টারভিউতে খুব বেশি ভালো করতে পারিনি। আরেকটা বিষয় হচ্ছে এ ধরনের ইন্টারভিউ দেয়ার আগে থিউরিটিক্যাল বিষয়গুলো ভালোভাবে পড়াশোনা করা লাগে এবং ঝালাই করে নেওয়া লাগে, যেটা ভালোভাবে করা হয় নাই। তারা কিছু টপিক নিয়ে ডিটেলস জানতে চায় যেটা খুব বেশি গভীরে যেতে পারি নাই, আমার উত্তর গুলা ছিল অনেকটা ভাসা ভাসা। ফাইনাল ইন্টারভিউর দুইদিন পরে এইচআর থেকে রিজেকশন ইমেল আসলো, সেখানে ওরা জানালো আমার কমিউনিকেশন ভালো না হওয়ায় ওরা আমাকে নিতে পারতেছে না।

ইন্টারভিউতে যে ভুলগুলো ছিলঃ

  • এধরনের ইন্টারভিউ কন্ডাক্ট করার আগে ইংলিশ স্পিকিং ভালোভাবে প্র্যাকটিস করা হয়নি, যে জন্য কোন কিছু এক্সপ্রেস করতে চাইলেও জড়তা ছিল।

  • থিউরিটিক্যাল জিনিসপত্রগুলো শুধু পড়া না, ওইগুলা থেকে নোট কালেক্ট করে সামারি বের করাও জরুরী। নাহলে যেটা সমস্যা হচ্ছে ইন্টারভিউতে হুটহাট অনেক কিছু মনে থাকে না, যেটা রেড ফ্লাগ বাড়িয়ে দেয়।

  • "টেল মি এবাউট ইউরসেল্ফ" এই ধরনের প্রশ্নে নিজেকে আরো সুন্দর ভাবে প্রেজেন্ট করার দরকার ছিল। কারণ শুরুটা ভাল হলে কনফিডেন্স অনেকগুনে বেড়ে যায়।

এই জিনিসগুলা একটু নারচারিং করে আবার লিংকডইন দেখে পুরোদমে বিভিন্ন জবপোস্টে অ্যাপ্লাই শুরু করি। শুরুর দিকে জব অ্যাপ্লিকেশন গুলা থেকে রেসপন্স পাচ্ছিলাম না, কেউ ইন্টারভিউর জন্য ডাকছিল না। কেন এটা হচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না, ধারনা করে নিলাম হয়ত সিভিতে সমস্যা। তারপর ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে সিভিটা আবার নতুন ভাবে তৈরি করি, এবং সিভির কন্টেন্টগুলো ভালভাবে ঢেলে সাজাই। নতুন সিভি দিয়ে বিভিন্ন পোস্টে এপ্লাই করার পর রেসপন্স রেট বাড়তে শুরু করে। এরপরে বিভিন্ন জব পোস্টে বিভিন্ন ফরম্যাটের সিভি দিয়ে এবি টেস্ট করি এবং আমার রোল অনুযায়ী একটা স্ট্যান্ডার্ড সিভির ফরমেট ফাইনালাইজ করি। কিভাবে একটা সুস্বাদু সিভি লিখা যায় সেটা নিয়ে আমার একটা লেখা আছে, এটা পড়লে বিস্তারিত জানা যাবে।

এরপর প্রায় শ-খানেক ইউরোপিয়ান কোম্পানিতে বিভিন্ন পোস্টের জন্য এপ্লাই করে ফেলি। কয়েকটা কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দেওয়া শুরু করি, সমস্যা হচ্ছে এদের স্ট্যান্ডার্ড খুব হাই হওয়াতে আমি স্ক্রিনিং ইন্টারভিউ ই পার করতে পারতেছিলাম না। কিন্তু কোনভাবে হাল না ছেড়ে আমি প্রতিনিয়ত আমার মত করে চেষ্টা করেই যেতে থাকি। একটা কথা আমি মনে প্রাণে খুব বিশ্বাস করি সেটা হচ্ছেঃ

"তোমার কাজে যদি দক্ষতা আর চেষ্টা থাকে, তাহলে সাফল্য সময়ের ব্যাপার মাত্র।”- ওয়ারেন বাফেট

২০২০ এর শুরুতে মেডিকেল সফটওয়্যার তৈরি করে এরকম একটা জার্মান স্টার্টপ কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দেই, এখানে আমি তুলনামূলকভাবে ভালো করলেও শেষমেষ ওরা হায়ার করে নাই। কথা ছিল টিম ইন্টারভিউ হওয়ার পরই আমাকে জব কনট্রাক্ট পাঠিয়ে দিবে, কিন্তু পরে ওরা রিজেক্ট করে দেয় কোন কারণ ছাড়াই। রিজেকশন ইমেলেও কোন ফিডব্যাক ছিল না, যেটার জন্য ঠিক কোন জায়গায় গুলোতে ভুল করেছি সেটা বোঝার উপায় ছিল না। এই কোম্পানিতে একদম শেষ ইন্টারভিউটা ছিল টিম ইন্টারভিউ এবং এটাতে ওরা অনেক বিহেভিওরাল প্রশ্ন করেছিল, যেমনঃ কেন জার্মানি আসতে চাই? বাংলাদেশ ছাড়ার কারণ কি? কেন আমি এতসব কোম্পানি থাকতে তাদের কোম্পানিতে আগ্রহী হই? আমার স্পেশাল কি বৈশিষ্ট্য আছে এই কোম্পানিকে দেওয়ার মত? এইসব প্রশ্নের জন্য ভালো পূর্বপ্রস্তুতি না থাকার কারণে নিজের কোনো সঠিক স্টোরি দাড় করাতে পারিনি এবং এবং আমার উত্তরগুলো যথেষ্ট স্ট্রং না হওয়াতে ওদের কাছে সম্ভবত লেজিট মনে হয় নাই।

এরপর আরো কিছু কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দেই সেই একই সমস্যা, মাঝে বা শেষের দিকে এসে রিজেকশন। প্রত্যেকটা কোম্পানি অনেকগুলো করে ইন্টারভিউ নেয়, কোন একটা ধাপে ভালো করতে না পারলে সাথে সাথে রিজেক্ট করে দেয়। ইন্টারভিউতে ডাইভার্স লোকজন থাকে, সবাইকে সবসময় সন্তুষ্ট করা একটু চেলেঞ্জিং। একেক জন একেক ধরনের সমস্যা দিত সমাধান করার জন্য, প্রচুর লাইভ কোডিং করাতো। লাইভ কোডিং এর সময় সীমিত হওয়ায় অনেক সময় পুরো সমাধান করা সম্ভব হতনা, আবার অনেক সময় সমস্যা গুলো অনেক কঠিন হওয়ায় ঠিক মত বুঝতামই না। আবার এমনও হয়েছে ১ ঘন্টার লাইভ কোডিং ২০ মিনিটে শেষ করে বসে রয়েছি, কিন্তু বিহেভিওরাল প্রশ্নের উত্তর ইন্টারভিউয়ারদের পছন্দ না হওয়ার কারণে রিজেকশন খেয়েছিলাম। মোটামুটি প্রায় ২৫-৩০ টা কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দেওয়ার পর আমি একরকম ক্লান্ত হয়ে যাই। কারণ একটা চাকরি করার পাশাপাশি এইসব প্রস্তুতি নেয়া এবং প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন সফট্যাওয়ার অ্যাসাইনমেন্ট করা লাগত। নিজেকে স্ট্রেস থেকে রিলিফ করার জন্য তখনকার মতো আমি ইন্টারভিউ দেওয়া থেকে বিরতি নেই। এরপর ছোটখাটো একটা রিমোট জবে জয়েন করি, যেটাতে স্যালারি ইউরোপের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী বেশ কম হলেও আমার প্রধান লক্ষ্য ছিল ওদের কালচার শিখা, অ্যাটিচিউড বোঝা এবং আমার কমিউনিকেশন ইমপ্রুভ করা।

২০২১ এর মাঝামাঝি এসে আবার জব হান্টিং শুরু করি। একটা লং ব্রেক নেওয়াতে স্ট্রেস মুক্ত ছিলাম এবং প্রতিটা ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় এনার্জেটিক ফিল করতেছিলাম। কিছুদিন রিমোট জব করায় কমিউনিকেশন আগে থেকে কিছুটা ইম্প্রুভ এবং স্ট্রাকচার্ড হয়েছিল। এবার ইন্টারভিউ শুরুর আগে থেকেই নিজেকে একটু গুছিয়ে রেখেছিলাম, যেমন ইন্টারভিউয়ার যদি আমার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে তাহলে টেকনিক্যাল এবং নন-টেকনিক্যাল মানুষ ভেদাভেদে আমি কি ধরনের উত্তর দিব। টেকনিক্যাল ইন্টারভিউ গুলাতে সাধারণত যে ধরনের প্রশ্ন করে সে ধরনের জিনিসপত্রগুলা পড়াশোনা করে আগেই কিছু নোটস নিয়ে রাখছিলাম, যেন ইন্টারভিউ শুরু করার আগে ওই জিনিসগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিতে পারি। চার-পাঁচটা ইন্টারভিউ দেওয়ার পরে আমার নেদারল্যান্ডের প্রথম কোম্পানি আমাকে ট্যালেন্ট আইও (জব খোঁজার ওয়েবসাইট) নামে একটা ওয়েবসাইট থেকে রিচ করে, পরে ওদের জব রিকোয়ারমেন্ট দেখে সন্তুষ্ট হওয়ার পর ইন্টারভিউ দেই। এইখানে আমার পাঁচটা ইন্টারভিউ দেওয়া লাগছে, এইচআর, টেকনিক্যাল, কোড রিভিউ, বিহ্যাভিওরাল, এবং ফাউন্ডার এর সাথে ইন্টারভিউ। কোম্পানিভেদে চারটা থেকে আট-দশটা পর্যন্ত ইন্টারভিউ দেওয়া লাগে, এটা নিয়ে আলাদাভাবে আমার একটা লেখা আছে। এই কোম্পানিতে ইন্টারভিউ বেশ ভালো হওয়ায় এখান থেকে জব অফার পেয়ে যাই। হল্যান্ডের কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দেওয়ার পাশাপাশি প্যারালালী জার্মানি, ফিনল্যান্ড এবং ইউএস এর কয়েকটা কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিচ্ছিলাম। ফিনল্যান্ড এবং ইউএসএ'র ইন্টারভিউ সাকসেসফুল হওয়ার পর ওইগুলা থেকে জব অফার পাই, এর মধ্যে ইউএসএ'র জবটা হচ্ছে রিমোট। ওই সময় রিমোট জব করতে চাচ্ছিলাম না, আমার উদ্দেশ্য ছিল সাম হাউ ইউরোপের মধ্যে মুভ করা। ফিনল্যান্ড এবং নেদারল্যান্ডের মধ্যে সাইড বাই সাইড কম্পেয়ার করে নেদারল্যান্ডকেই পারফেক্ট মনে হল। নেদারল্যান্ডে এক্সপ্যাটদের জন্য ৩০% টেক্স রুলিং সহ অনেক সুবিধা দিয়ে থাকে। এখানে মোটামুটি ৯০ ভাগ মানুষ ই ইংলিশে কথা বলতে পারে, যেটার জন্য আলাদা করে ভাষা শিখার দরকার নেই। এখানের মানুষজন খুব ফ্রেন্ডলি এবং ওপেন মাইন্ডেড। সব মিলিয়ে নেদারল্যান্ডকেই নেক্সট ডেসটিনেশন হিসাবে পারফেক্ট মনে হয়।

ভিসা প্রসেসিং

সেলারি নেগোসিয়েশন শেষে আমি কনফার্ম করার পর পরই আমার কোম্পানি নেদারল্যান্ড ইমিগ্রেশনে হাইলি স্কিলড মাইগ্রেন্ট হিসাবে ওয়ার্ক পারমিটের জন্য এপ্লাই করে দেয়। আমি শুধু আমার পাসপোর্ট এবং প্রয়োজনীয় কিছু ডকুমেন্টস কোম্পানিকে দেয়া লাগছে, আর কিছুই আমার করা লাগেনি। ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যেই আমার ওয়ার্ক পারমিট এপ্রুভ হয়ে যায়, এরপর এম্বাসিতে পাসপোর্ট জমা দেই ভিসা স্টাম্পের জন্য। ওয়েটিং পিরিয়ডের মধ্যেই ভিসা স্টাম্পের জন্য আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখছিলাম, তাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট এর জন্য আর আলাদা করে অপেক্ষা করা লাগে নাই। পুরা প্রসেস সম্পন্ন হতে ২৩ থেকে ২৪ দিন লাগছিল। নেদারল্যান্ড ইমিগ্রেশনের ওয়েবসাইটে সব ধরনের তথ্য খুব সুন্দর করে সাজানো আছে, যাওয়ার আগে কি কি করা লাগবে, কি কি ডকুমেন্টস লাগবে, এখানে আসার পর কি কি করা লাগবে। দেশে থাকতেই কোম্পানির এইচ আর কে দিয়ে সিটিজেনশিপ নাম্বার এবং রেসিডেন্স কার্ডের জন্য এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখি।

নেদারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা

পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার পর শুধু বিমানে টিকেট কাটা বাকি। আমার কোম্পানি স্টার্টআপ হওয়ায় ওইসময় ওরা রিলোকেশন খরচ দিতেছিল না, তাই ব্যক্তিগত খরচে বিমানের টিকেট কাটি এবং এক মাসের জন্য হোস্টেলে সিট বুক করি। জীবনের প্রথম প্লেন জার্নি তাও আবার ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটে, একটু চিন্তায় ছিলাম যে কিনা কি হয়। বাংলাদেশ থেকে সরাসরি নেদারল্যান্ডের কোন ফ্লাইট নেই, তুর্কি/সৌদি/কাতার/দুবাই এয়ারলাইন্স ভেদে মাঝে যে কোন একটা দেশে বিমান পরিবর্তন করা লাগে। তখন কোভিডের পিক টাইম থাকার কারণে, নেদারল্যান্ডে ল্যান্ড করার পর সরাসরি ট্যাক্সি নিয়ে হোস্টেলে চলে যাই। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী প্রথম সপ্তাহ কোয়ারেন্টাইন করতে হবে। পরের দিন ঘুম থেকে উঠে সরকারি হেলথ সার্ভিস নাম্বারে ফোন করে কোভিড টেস্ট করার জন্য এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখি। তৃতীয় দিন কোভিড টেস্ট নেগেটিভ আসায় পরদিন থেকে অফিসে যাওয়া শুরু করি। দুই সপ্তাহ পরে রেসিডেন্ট কার্ড এবং সিটিজেনশিপ নাম্বার পাই, তারপর লোকাল পৌরসভাতে আমার ঠিকানা রেজিস্টার করি। সিটিজেনশিপ নাম্বার পাওয়ার পর স্যালারি নেওয়া এবং কেনাকাটা করার জন্য ব্যাংক একাউন্ট খুলি।

পরিশেষ

যদি আমার অবস্ট্যাকলগুলা ফেইস করতে না হত, তাহলে আজকের এই ছোট্ট জীবনটা উপভোগ করার ক্ষমতা জন্মাত না। প্রচুর ফেল করছি, রিজেকশন খাইছি যেটা আমাকে অনেক কিছু শিখতে সহযোগিতা করছে। খুব দ্রুত সবকিছু পেয়ে গেলে হয়তো অনেক কিছু শেখা হতো না, যেটা আমার ফাউন্ডেশনকে আরো স্ট্রং করতে সহায়তা করেছে।

শিক্ষনীয় বিষয়

  • কোন কাজে ব্যর্থ হলে ভাববেন না আপনার জীবন শেষ, পুনরায় চেষ্টা করতে হবে। সবসময় ইতিবাচক মানসিকতার অনুশীলন করে ইতিবাচক মানুষদের সাহচর্য বজায় রাখতে হবে। হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না, প্রয়োজনে বিরতি নেয়া যেতে পারে। মানুষ পারেনা পৃথিবীতে এমন কোন কাজ নেই, কারন সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সমস্ত শক্তি দান করেছে। শুধুমাত্র প্রচন্ড ইচ্ছা শক্তি থাকলেই আমরা যেকোন অসাধ্য কে সাধন করতে পারি।

  • একজন মানুষকে তার জীবনের প্রতিটি ধাপের জন্য নিজেকে তৈরি করতে হয়। যেকোনো কাজে সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস, সুনিশ্চিত পরিকল্পনা এবং ভালো প্রস্তুতি। শুধুমাত্র কাজের পরিকল্পনা করাই যথেষ্ট নয়, পরিকল্পনা অনুযায়ী তা বাস্তবায়িত করাটাই সবচেয়ে জরুরি।

  • একটা ভালো জব পোস্টে অনেক প্রতিযোগি থাকে, প্রতিযোগিতায় নিজেকে এগিয়ে রাখার জন্য সিভিতে ভালো এবং গোছানো কনটেন্ট অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটা সিভিতে অনেকগুলা সেকশন থাকে, প্রত্যেকটা সেকশন আপনাকে এবং আপনার পেশাদারী অভিব্যাক্তি ফুটিয়ে তোলে। ২০২৩ সালে এসে কাউকে নিজে সিভি লিখার জন্য পরামর্শ দেই না। ভালো সিভি বানিয়ে দেয়ার জন্য আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স বা পেশাদার কোন সার্ভিসের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে যেমন: chatGPT, https://novoresume.com

  • মোটামুটি প্রায় সব কোম্পানিই লিংকডইন থেকে রিচ করে, তাই লিংকডইনে প্রফেশনাল প্রোফাইল বানানোর জন্য সবসময় পরামর্শ দেই। সুন্দর করে সামারি লেখা, জব এক্সপেরিয়েন্স এবং স্কিলস গুলা সুন্দর করে সাজানো। রিকমেন্ডেশন কালেক্ট করা এবং একটা ভাল নেটওয়ার্ক তৈরি করা।

  • বাংলা ভাষী হওয়াতে আমাদের অনেকেরই ইংরেজিতে কথা বলার চর্চা থাকেন, অভ্যাস না থাকার কারণে মুখে একটা জড়তা থেকে যায়। ইংলিশে স্পিকিং এর অভ্যাস না থাকলে নিয়মমাফিক অল্প অল্প করে প্র্যাকটিস করতে হবে। যেমন মুভি দেখার সাথে সাথে জোরে জোরে স্পিকিং করা।

  • "টেল মি এবাউট ইউরসেল্ফ" এই প্রশ্নের জন্য নিজের সম্বন্ধে একটা সামারি লিখে রাখা যেতে পারে, এবং সুন্দরভাবে কিভাবে উপস্থাপন করা যায় সেই জন্য প্র্যাকটিস করতে হবে। ইন্টারভিউর সময় নিজের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট গুলা অনেক সময় মনে থাকেনা, সে জন্য প্র্যাকটিস করাটা জরুরী।

  • বিহেভিওরাল প্রশ্নের জন্য আগে থেকেই লেজিট স্টোরি/উত্তর সাজিয়ে রাখা, যেন ইন্টারভিউয়ার নিজে থেকে বুঝতে পারে আপনার কারণগুলা যৌক্তিক। যেমনঃ আপনি কেন বর্তমান কোম্পানি ছাড়ছেন? নতুন জবে এমন কি আছে যার জন্য আপনি আগ্রহী?

  • যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কোডিং চ্যালেঞ্জ জমা দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এখানে আপনাকে প্রচুর আন্তর্জাতিক প্রার্থীদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। অযথা অপেক্ষা করে সুযোগের সভম্ভবনা নষ্ট করবেন না। “সময় এবং স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না।” এই সদা সত্য বাক্য আমরা সবাই জানি এবং কিছু মানুষ মানে তবে আমরা অনেকেই মানি না।

  • কোম্পানি সম্পর্কে, টেকনিক্যাল এবং নন টেকনিক্যাল পারসন দের কি কি প্রশ্ন করা যায় সবকিছু একটা নোটে লিখে রাখা। যেমন এইচআর কে কি প্রশ্ন করা যায়, কোম্পানির ফাউন্ডারকে কি প্রশ্ন করা যায়, যারা টেকনিক্যাল পারসন তাদেরকে কি প্রশ্ন করা যায়। যাতে ইন্টারভিউ চলাকালীন সময়ে নোট দেখে প্রশ্ন করা যায়। প্রশ্ন করাকে ইন্টারভিউয়াররা খুব পজিটিভ ভাবে নেয়, এবং মনে করে যে ক্যান্ডিডেট কোম্পানি সম্পর্কে ভালোভাবে স্টাডি করেছে। কোন প্রশ্ন ছাড়া ইন্টারভিউ শেষ করা একটা রিস্ক ফ্যাক্টর তৈরি করে।

কারো কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্টে করতে পারেন, অবসরে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করব।